সাদাকার গল্প "মানুষের মনে হাসি ফোটাও, তাদের কষ্টগুলো দূর করে দাও, আর এসবের প্রতিদান চাও মহানুভব রব আল্লাহর কাছে।"

 সাদাকার গল্প 

"মানুষের মনে হাসি ফোটাও, তাদের কষ্টগুলো দূর করে দাও, আর এসবের প্রতিদান চাও মহানুভব রব আল্লাহর কাছে।"


গল্পটা সৌদি আরবের অনন্য এক দানশীল ব্যক্তির। তাঁর নাম শেখ সুলায়মান আল রাজী। দু'হাতে তাঁর দানের কথা কিংবদন্তি হয়ে আছে। বিশ্বের বড় ইসলামি ব্যাংক ও বড় খেজুর বাগানের মালিক তিনি। পুরো রমজান মাসে এ বাগানের খেজুর দিয়েই মক্কা মদিনার রোজাদারদের ইফতার করানো হয়।


পরিশ্রম কীভাবে একেবারে শূন্য থেকে এ মানুষটিকে মাল্টি বিলিয়নিয়ার তথা বিশ্বের ১২০তম ধনী মানুষে পরিণত করেছে এবং দু'হাতে দান করে তিনি কেমন আনন্দ পেতেন সেটা অনুপম আশা জাগানিয়া এক গল্প। আসুন সে গল্পটাই আমরা শুনি!


সুলায়মান আল রাজী ছিলেন সৌদি এক অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তান। শৈশবে স্কুলে পড়ার সময় এক শিক্ষা সফরে যেতে পরিবারের কাছে কান্নাকাটি করেও এক রিয়াল জোগাড় করতে পারেননি। কারন এক রিয়াল দেয়ার মতো সামর্থ্য তাঁর পরিবারের তখন ছিল না। শিক্ষা সফরের একদিন আগে ফিলিস্তিনি ক্লাশ শিক্ষক স্কুলে প্রশ্নের সঠিক জবাব দেয়ায় তাঁকে এক রিয়াল উপহার দেন। মুহূর্তেই তাঁর প্রবল কান্না পরম আনন্দে পরিণত হয়। তিনি সহপাঠীদের সাথে শিক্ষা সফরে যেতে সুযোগ পান।


কর্মজীবনে যোগদানের জন্য ৯ বছর বয়সে তিনি স্কুল ছেড়ে দেন। প্রথমেই বন্দরে মাল ওঠানোনামানো অর্থাৎ পোর্টারের কাজ করেন। এরপর দিনমজুর, শ্রমিক,বাবুর্চি, ওয়েটার, দোকান কর্মচারীর কাজ করেন। উপার্জনের অর্থ দিয়ে মুদি দোকান দেন। বিয়ের খরচের জন্য দোকান বিক্রি করে দেন। তারপর ভাইয়ের সাথে একত্রে ব্যবসা শুরু করেন। ১৯৭০ সালে ভাইয়ের কাছ থেকে আলাদা হয়ে একা কারেন্সি ট্রেডিং (মুদ্রা বিনিময়) ব্যবসা শুরু করেন। প্রথমে সৌদি আরবে ৩০টি শাখা এবং পরে মিশর,লেবানন ও জিসিসি দেশগুলোতেও শাখা খুলেন। বদলে যায় ভাগ্যের চাকা। প্রতিষ্ঠা করেন আল রাজী ব্যাংক ও আল রাজী ইসলামিক গ্রুপ। অন্য আরো ব্যবসা।


বিশ্বের সবচেয়ে বড় খেজুর বাগানটি তাঁর। এ বাগানে ২ লক্ষ খেজুর গাছ আছে। মধ্য সৌদি আরবের আল কাসিম প্রদেশে অবস্থিত এ বাগানের আয়তন প্রায় সাড়ে ৫ হাজার হেক্টর। এ বাগানে ৪৫ ধরনের খেজুর আবাদ হয়। ১৯৯০ সালে এখানে গম এবং তরমুজও করা হতো। কিন্তু ১৯৯৩ সালের পর শুধু খেজুর ফলানো হয়। বাগানটি গিনেজ বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে স্হান করে নেয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে শেখ সুলায়মান আল রাজী এ বাগানটি আল্লাহর রাস্তায় পুরোপুরি ওয়াকফ করে দেন। রমজানে কা'বা শরীফ ও মসজিদে নববী এবং অন্য মসজিদসমূহে এ বাগানের খেজুর দিয়েই ইফতার করানো হয়। মুসলিম দেশগুলোতে এ বাগানের খেজুরই উপহার হিসেবে পাঠানো হয়। এর আয় ব্যয় কর হয় দরিদ্রদের সহায়তায়।


ফোর্বস সাময়িকীর মতে শেখ সুলায়মান আল রাজীপৃথিবীর ১২০তম ধনী ব্যক্তি। সৌদি রয়েল ফ্যামিলির বাইরে নিজের উপার্জনে একমাত্র কোরপোরেট বিলিয়নিয়ার। তাঁর সম্পদের পরিমান ৭.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তিনি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ২০ জন মানবিক সহায়তা প্রদানকারীর মধ্যে অন্যতম। আল রাজী ব্যাংকের ২০ শতাংশ অর্থ সৌদি দরিদ্র শিশুদের জন্য ব্যয় করা হয়। তিনি স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মসজিদ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তিনি তাঁর সমুদয় সম্পদের দুই তৃতীয়াংশ চ্যারিটির জন্য দান করেছেন। বাকিটা ছেলেমেয়েদের মধ্যে বন্টন করে দেন।


মোটামুটি ধনী হওয়ার পরই সুলায়মান আল রাজীর মনে পড়ে তাঁর সেই শিক্ষকের কথা। তিনি তাঁকে খুঁজে বের করেন। সাক্ষাৎ হলে তিনি দেখতে পান তাঁর ফিলিস্তিনি শিক্ষক কর্মহীন এবং দারিদ্রতার মধ্যে কষ্টে জীবন যাপন করছেন। তিনি তাঁকে তার পরিচয় দেন এবং শৈশবে এক রিয়ালের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে শিক্ষক তাঁকে চিনতে পারেন। তিনি শিক্ষককে গাড়িতে উঠান এবং একটি বাগান বাড়িতে নিয়ে যান। তাকে গাড়িসহ বাগান বাড়ি উপহার দেন। সাথে দেন সারাজীবন চলার জন্য শিক্ষককে খরচের টাকা। আবেগ আপ্লুত শিক্ষক তাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। কিন্তু সুলায়মান আল রাজী তাঁর শিক্ষককে বলেন, "আপনি আজ খুশীতে কাঁদছেন। তারচেয়েও বেশি খুশি হয়েছিলাম আমি সেদিন, যেদিন আপনার কাছ থেকে এক রিয়াল উপহার পেয়েছিলাম। আমার জন্য সেই উপহারটা ছিল অতুলনীয়। সেদিন আপনি বলেছিলেন, "মানুষের মনে হাসি ফোটাও, তাদের কষ্টগুলো দূর করে দাও, আর এসবের প্রতিদান চাও মহানুভব রব আল্লাহর কাছে। সেটা ঠিকই বলেছিলেন। মহান আল্লাহ আমাকে ধন সম্পদ দিয়ে ভরে দিয়েছেন। আর হালাল পথেই এসেছে এ সম্পদ।"


বয়স এখন ৯৭ বছর। জীবন সায়াহ্নে সুলায়মান আল রাজী তাঁর সম্পদ পরিবার ও আল্লাহর রাস্তায় বন্টন করে দেয়ার পর এক সাক্ষাৎকারে বলেন, "আমি এখন মুক্ত। মুক্ত আমি পাখির মতোই। নিজেকে খুব হালকা লাগছে। মহান আল্লাহর ডাকের অপেক্ষায় আছি। মহান রবের মেহমান হতে পারাটাই সৌভাগ্যের"!


শেখ সুলায়মন আল রাজী সৌদি আরবে খুবই সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। দানশীলতা ও দেশের উন্নয়নে অবদানের জন্য তাঁকে সৌদি আরবের বড় পুরস্কার "বাদশা ফয়সাল" পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।


সংগৃহীত।






No comments:

Post a Comment